হৈমন্তী
বিশ্ব
কবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুরের অন্যতম জনপ্রিয় একটি ছোট গল্প।
আমার
শিক্ষকগণ বলতেন রবীন্দ্র চর্চা করলে নিজের জীবনকে স্ফুটিত গোলাপের মতই প্রস্ফুটন ঘটানো
সম্ভব। বন্ধুরা আমরা লেখক কবি গুরুর প্রসঙ্গ এখানেই সমাপ্ত করে ছোটগল্প হৈমন্তী নিয়ে
আলোচনা করবো। কারন বিশ্ব কবি রবীন্দ্র নাথকে নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যা বর্ণনা দিতে গেলে জীবনের
আরো অনেক গুলো যুগ রবীন্দ্র নাথের লেখা সমগ্র পাঠ করতে হবে। এ স্বল্প জ্ঞানে বিদ্যায়
কবি গুরু সম্পর্কে লিখবার সাহস আমাদের হবার কথা নয়।
১১৯
টি ছোট গল্প লিখে কবি গুরু ছোটগল্পের জনক হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেছেন। জমিদারপুত্র রবীন্দ্রনাথের
ভাবাদর্শ চিন্তা চেতনা কখনোই অত্যাচারী জমিদার মোড়ল বা পঞ্চায়েত সূলভ ছিলনা যা’তার
সমগ্র রচনাবলীতে স্বাক্ষবহন করে।
অনিমতান্ত্রিক
সমাজে কুঠার আঘাত হেনে হীন মনোবৃত্তি স্বভাবের মানুষগুলোকে লোভ লালসা ও কুসংকারের বিরুদ্ধে
কঠোর অবস্থান ছিলল কবি গুরু রবীন্দ্র নাথের।
তার
সকল গল্পে কবিতায় আমরা দেখি মহান বিধাতার প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ, মানুষের প্রতি ভালোবাসা,
প্রেম প্রীতি সৌহার্দ্য স্নেহ মায়া মমত্ববোধ এবং সামাজিক ও পারিবারিক দৈনন্দিন জীবনে
সকল প্রকার অসংগতি, কলহ বিবাদ বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী লেখাসমূহ।
চলো
তাহলে হৈমন্তীকে নিয়ে আলোচনা করি।
হৈমন্তী
গল্পে কবি বাংলার সমাজে ঘরে ঘরে তথা সমাজ জীবনের এমন কিছু অভাবনীয় চিত্র চরিত্র ও একটি
পরিবারের অভ্যন্তরের মধুর সম্পর্কের মাঝে ঘটে যাওয়া ক্ষুদ্র কিংবা বিশাল প্রকৃতির হৃদয়
মর্মকে ছুয়ে যাওয়া কথাগুলো এবং হিন্দু সমাজের কিছু কুসংস্কারের বিষয়টিও তুলে ধরেছেন।
গল্পের
নামকরণ করা হয়েছে হৈমন্তীর নামানুসারে। হৈমন্তী অত্যন্ত মার্জিত সাদা সিধে শিক্ষিত
মেয়ে। হিমালয়ের পাদদেশে মাতৃহীন হৈমন্তী শিক্ষিত উদার মন মানসিকতা সম্পন্ন বাবার স্নেহ
মমতায় বেড়ে ওঠা একটি সাদা সিধে মেয়ে। হৈমন্তী মিথ্যে প্রতারণা বা অন্যায় অপরাধকে প্রশ্রয়
দেবার মত মেয়ে নয়। কারন সে নিজে ভাল মনের অধিকারী বিধায় সকলের মাঝেই সে ওই একই সহজ
সরল মন মানসিকতাকে দেখতে পায়। অর্থাৎ সে ভালো মেয়ে বলে সবাইকে ভালো চোখেই দেখে থাকে।
গল্পের
শুরু ও শেষ উভয়ই হৈমন্তীকে নিয়ে। হৈমন্তীর বয়স হয়েছে বিয়ের জন্য তাড়া একটু বেশী।
গল্পটি সীমিত কয়েকটি চরিত্র নিয়ে লেখা হয়েছে । হৈমন্তী তার বাবা এবং শশুড়ালয় ঘিরে সম্পন্ন হয়েছে ।
গল্পের নায়ক অপু
আর নায়িকা হৈমন্তী নামানুসারেই এই গল্পটির নামকরণ করা হয়েছে হৈমন্তী।
বন্ধুরা
এ ছোটগল্পটি এপার বাংলা ও পার বাংলা অর্থাৎ দুই বাংলার শিক্ষিত সমাজ এবং শিক্ষকমন্ডলীদের
নিকটও অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং পাঠ্য পুস্তকেও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যূগের পর যূগ থেকে।
বন্ধুরা
আজ আমি ৭০ এ পা দিয়েছি। আমারও এইস এস সির পাঠ্য পুস্তকে হৈমন্তী ছিলো প্রধান বাংলা
প্রথম পত্রের তালিকায়।
অপু
এ গল্পের নায়ক এবং অপুর মূখেই গল্পটি বর্ণিত হয়েছে মিস্টি মধুর প্রাঞ্জল ভাষায়। যেমন
কথাশিল্পী শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিলাসী ছোট গল্পটিও একজন কথকের ভাষায় অর্থাৎ ন্যাড়া
নামক একটি যুবকের মূখে বর্ণিত হয়েছে।
অপু
অর্থাৎ হৈমন্তীর স্বামী মাতৃহীন হৈমন্তীকে একটু বয়স্ক বিধায় বড় ধরনের পন অর্থাৎ মোটা
অংকের যৌতুক নিয়েই বিয়ে করেছিল। কারন অপু অনেক ধনী পরিবারের সন্তান ছিল। অনেক বয়সে
মেয়ে বিয়ে দিতে হলে সব বাবাদেরই যেমন মোটা অংকের পনের টাকা গুনতে হয়, তেমনি হৈমন্তীর
বাবাও অনেক বেশী পণ দিয়ে মেয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন।
কিন্তু
বিবাহের পর সামাজিক কুসংস্কার ও ব্যধির কারনে হৈমন্তীর সুখের সংসারে সুখ নামের পাখী
পালাতে বাধ্য হয়। অপদস্ত্য হতে হয় শ্বশুড় শ্বাশুড়ির নিকট । হৈমন্তীর স্বামী শত চেস্টা
করেও মা বাবাসহ সামাজিক অব্যবস্থা ও কুসংস্কারের কারনে সফলকাম হয়নি।
যদি
গল্পের একটু গোড়ার দিকে যাই তাহলে দেখা যাবে বর পক্ষের বিয়ের ব্যাপারে অতিরিক্ত উৎসাহ
ছিল কারন অপুর ভাষায় স্পষ্ট বোঝা যায় যে মেয়ের বয়স যত বেশি তার চেয়ে যৌতুক বা পনের
টাকার পরিমানটা তার চেয়েও বেশি পাওয়া যাবে, সে কারনেই বিয়ের জন্য তাড়াহুড়া । পাছে হৈমন্তী
আবার মত ঘুরিয়ে দিয়ে যদি বিয়ে না করে তাহলে তো সব হাত ছাড়া হয়ে যাবে। এ কারনেই অপুর
পরিবারের বিয়ের প্রতি আগ্রহ অত্যধিক বলে প্রমান করে।
অতঃপর
হৈমন্তীর বিয়ে হলো খুব ঘটা করেই। শিক্ষিত পিতা ও সহনশীলা ভদ্র মার্জিত আদর্শবান মেয়ের
মধ্যে বিচ্ছেদ হলো।
বন্ধুরা
তোমরা জানো মেয়ের বাবাকে কন্যাদান করতে হয়। এক বাবা আর এক বাবার হাতে নিজের মেয়েকে
সমর্পণ করে চিরকালের জন্য।
এ
মেয়ে এবং এ মেয়ের ভালো মন্দ দেখার ভার এত দিন আমার ছিলো, আজ থেকে আমার এ মেয়ে আপনার
মেয়ে হয়ে গেলো। এর সকল সুখ শান্তি ভাগ্য নির্ধারণ ছেলের বাবা ও পরিবারের হাতে অর্পিত
হলো।
হৈমন্তীর
বাবা মেয়ে বিয়োগের শোকে এতটুকু ম্রিয়মাণ তা’ প্রকাশ করলেন না, কাউকে বুঝতে দিলেন না
যে তিনি তার বুকের ধন একমাত্র কন্যাকে আজ অজানা অচেনা কোন একটি পরিবারে প্রেরণ করছে।
কিন্তু হৈমন্তীর বাবা কেবল একটি কথাই অপুকে বললেন যে ধন দিলাম তাহার মুল্য যেনো বুঝতে
পারো। হৈমন্তীর বাবা তার মেয়েকে চিনেন, তিনি নিজ হাতে তাকে গড়েছেন আদর্শবান নারী হিসেবে।
মেয়ে বিসর্জনের কঠিন কস্টটাকে বুকের মধ্যে চাপা দিয়ে রেখে কেবল অপুকেই বললেন যে ধন
তোমাকে দিলাম তার মর্যাদা করবে এবং মূল্যায়ন করবে।
হৈমন্তীর
বাবা নিজের বুকের গহনের গভীর বেদনাকে শ্বান্তনা দেবার জন্য কিছুই রাখলেন না। রাখলেন
একটি সুন্দর বানী “ যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়া দিলাম। এখন ফিরিয়া তাকাইতে গেলে দুঃখ
পাইতে হইবে”
বন্ধুরা
এ সংলাপটি আমাদের সংজ্ঞা হিসেবে এসছিলো এ ভাবে “ যাহা দিলাম তাহা উজাড় করিয়া দিলাম,
এখন ফিরিয়া তাকাইতেগেলে দুঃখ পাইতে হইবে । অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার রাখিতে যাইবার
মত এমন বিড়ম্বনা আর নাই।
বিবাহ
কাজ সম্পন্ন হলো। হৈমন্তী শ্বশুরালয়ে গেলো। হৈমন্তীর শ্বশুর ভেবেছিলো যে হৈমন্তীর বাবা
রাজার মন্ত্রী বড় চাকুরী । বিয়ের প্রথমে পণ হিসেবে যে টাকা দিয়েছে তা তার নিজস্ব জমানো
টাকা
সূতরাং
হৈমন্তীর বাবার নিকট থেকে আরো অনেক কিছু পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই ছেলে অপুর ভবিষ্যত
উজ্জ্বল নক্ষত্রের ন্যায় ঝল মল করছে বিধায় হৈমন্তীর জীবন ঠিক ঠাকই চলছিলো।
একদিন
হঠাত অপুর বাবা জানতে পারে যে হৈমন্তীর বাবার দেয়া পণের টাকা তার নিজের নয় তিনি অন্য
কারো নিকট থেকে ধার করে বিয়েতে খরচ করেছেন এবং পণ দিয়েছেন অর্থাৎ তার নিজের টাকা এক্টিও
খরচ করেননি। ঘটনা উলটে গেলো আরো একটি কথা জানতে পেরে যে হৈমন্তীর বাবা কোন রাজার মন্ত্রী
নয় তিনি একটি স্কুলের সামান্য হেড মাস্টার মাত্র।
এ
সত্য ঘটনাটি জানার পর হৈমন্তীর জীবনে নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা। নির্যাতন নিপীড়ণে হৈমন্তীর
জীবন হয়ে উঠলো তিক্ত বিষাদময় অসহ্যনীয় যন্ত্রনাময়।
প্রথমেই হৈমন্তীর শ্বাশুড়ি অর্থাৎ অপুর মা হৈমন্তীকে শিখিয়ে দিচ্ছিল কতগুলো মিথ্যেকথা যা’ আদর্শ পিতার আদর্শ কন্যা মেনে নিতে পারেনি। তাই হৈমন্তীর শ্বশুরালয় ক্রমাগভাবে হয়ে উঠলো নরকবাস। বহুমূখী নির্যাতনে বিষয়ীয়ে উঠলো হৈমন্তীর জীবন।
ঐ
দিকে যে স্বামী অপু;
যার
হাতের স্পর্শে পুলকিত রোমাঞ্চিত হয়েছিলো হৈমন্তীর দেহ মন, তার সুশিক্ষায় আর সততায় মনে
মনে গর্ব বোধ করতো হৈমন্তী, সে অপুও তাকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়ে গেলো। কারন হাজার
বছরের ক্ষত বিক্ষত যে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ, সে সমাজের নোড়া বেড়াজালে আটকে পরেছিলো
অপু। নিজের চোখে নিজের বৌয়ের হেনস্থা অপমান তাচ্ছিল্য দেখেও নীরব দর্শকের মত দাঁড়িয়ে
থেকেছে প্রতিবাদ করতে পারছিলো না।
স্বামী
হিসেবে স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষার চেস্টা করেনি তা নয়। মাঝে মধ্যে প্রতিবাদের জন্য নিজেকে
প্রস্তুত করে চেস্টাও করেছে বহুবার কিন্তু পরিবারের তর্জন গর্জন এবং নোংড়া সমাজের শক্তির
নিকট হেরে যায় অপু।
সূতরাং
হৈমন্তীকে স্বামী অপুর মূখ থেকে শুনতে হয় দ্বিতীয় সীতা বিসর্জনের অদ্ভুত গল্প। যেখানে
সমাজ ও পরিবারের লোভ লালসার নিকট স্ত্রীর মর্যাদা মূল্যহীন অপাংতেয় হয়ে যায়।
অপুর
মা অপুর জন্য নতুন পাত্রীর সন্ধানে নেমেছে। অথচ হৈমন্তীর গুনমূগ্ধ স্বামী অপু না শব্দটি
উচ্চারণের ক্ষমতা রাখেনা।
এই যে কাপুরুষসম অপারগতার বাক্যটি দিয়েই কবি গুরু
গল্পটি শেষ করেছেন।
এ
গল্পটির মাধ্যমে কবি গুরু ঘুনে ধরা অসভ্য লোভ লালসায় মত্ত সমাজের অপমৃত্যুর দৃশ্য আঙ্গুল
দিয়ে দেখিয়েছেন।
বন্ধুরা
ভালো লাগলে শেয়ার করবে, মন্তব্য ও সাবস্ক্রাইব করতে ভুলবে না।
ধন্যবাদ